ছোটগল্প: গল্পটা আমার কিংবা কিশোরের!

Fiction

” আপনার কোন সহযোগিতার প্রয়োজন ?” প্রশ্নটি শুনে আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালাম। আজ আমার ইন্টার্ন জীবনের প্রথমদিন। একটি আইটি ফার্মে ইন্টার্ন হিসেবে যোগদান করেছি। যিনি প্রশ্নটি করেছেন তাঁকে চিনতে পারলাম না। অবশ্যই এই অফিসেরই কেউ হবে। এখনো এই অফিসের সকলের সাথে আমার পরিচয় হয়নি।

আমি নীলা। অবন্তী করিম নীলা। আমরা ৪বন্ধু একইসাথে এই অফিসে ইন্টার্ন হিসেবে যোগদান করেছি। আমার বন্ধু সাব্বিরের মামার অফিস এটি। সময়ে সময়ে নানান কাজে খালু, মামাদের প্রয়োজন হয় সেটা আরেকবার প্রমাণ হলো। আমরা চার বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একইসাথে একই অফিসে ইন্টার্নশীপ করবো। কিন্তু চারজনের একই অফিসে হচ্ছিলো না। তখন এই মামার সহযোগিতায় পেয়ে গেলাম।

যিনি প্রশ্নটি করেছেন তাঁর নাম কিশোর। তিনি আমাদের সুপারভাইজার। প্রথম যেদিন আমরা দেখা করতে এসেছিলাম তখন যার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিলো ইনি তিনি নন। পরে জানলাম যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো তিনি অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। তাই, দায়িত্ব এখন কিশোর ভাইয়ার উপর পড়েছে। আমরা তাঁকে ভাইয়া বলে ডাকতাম। স্যার ডাকতে তিনি নিষেধ করেছিলেন।

আমার সাথে সাথে আমার বন্ধুরাও তাঁর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। চার জনের অবাক হয়ে তাকানো দেখে তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর নিজের পরিচয় দিলেন এবং আমাদের নাম জানতে চাইলেন। আমি যে পিসিতে বসেছিলাম সেটার মাউসে সমস্যা ছিলো। ঠিকভাবে কাজ করছিলো না। আমি সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। তিনি রুমে ঢুকে পিছনে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করছিলেন। আমাকে শুধু মাউস নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে প্রশ্নটা করেছিলেন।

অফিস থেকে আমার বাসায় দূরুত্ব সবথেকে কম ছিলো। রিক্সা ভাড়া ১০ টাকা আর হেঁটে গেলে ৩০-৩৫মিনিট। ছেলেদের সময় আরো কম লাগে। আমার এমনিতেও কিছুটা ধীরে হাঁটি। তাই আমার সময় বেশি লাগে।

আরো পড়ুন : সম্পর্কে স্যরি বলা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

একদিন বাসা থেকে বের হওয়ার পর জোরে বৃষ্টি নামলো। ভাগ্যিস ব্যাগে মা মনে করে সবসময় ছাতা এবং পানির বোতল দিয়ে দেয়। আমি ছাতা বের করে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোন রিক্সা নেই। যে কয়টা রিক্সা আসছে সব কয়টাতে মানুষ আছে।

হুট কর একটি রিক্সা আমার সামনে এসে থামলো। রিক্সার ভেতর থেকে আমার নাম ধরে কেউ ডেকে রিক্সায় উঠতে বললো। আমি তাকিয়ে দেখি কিশোর ভাইয়া। তাঁর সাথে রিক্সায় উঠতে একটু দ্বিধা লাগছিলো। কিন্তু উপায় নেই। এ বৃষ্টি এখনই থামবে বলে মনে হচ্ছে না আর এই মুহূর্তে খালি রিক্সা পাওয়াও মুশকিল। আমি সকল দ্বিধা দূর করে তাঁর সাথে রিক্সায় উঠলাম।

আজকাল রিক্সাগুলো বানায় ছোট করে, তার মধ্যে হুট তোলা থাকলে রিক্সার সাইজ আরো ছোট হয়ে আসে। রিক্সা চলার সময় ঝাঁকিতে যখন আমাদের গায়ের সাথে গা লেগে যাচ্ছিলো সাথে সাথে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলো। ভদ্রলোক নিজেও যে বিব্রত হচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।

বাসে উঠলে কিংবা ভীড়ের মধ্যে একজন মানুষের সাথে অন্যজনের যে ধাক্কা লাগে সেটা সবাই স্বাভাবিকভাবে নেয়, যদি না ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নোংরামি করে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের দুইজনের মধ্যে কারো ইনটেনশন খারাপ নয়। এবং যে সামান্য ধাক্কা লাগছে সেটা খুবই স্বাভাবিক। তবুও দুজন কেন জানি খুব বিব্রত হচ্ছি।

সেদিন অফিসে কেন জানি আমি তাঁর দিকে তাকাতে পারিনি। আমার কেন জানি খুব লজ্জা লাগছিলো। তিনিও সেদিন আমার সাথে খুব বেশি কথা বলেননি। সত্যি বলতে কোন কথাই বলেননি। অন্য সময় আমাদের সকলের নাম নিয়ে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করেন আমরা বুঝেছি কিনা, কোন প্রশ্ন আছে কিনা। তারপর কাজ দেখতে আসলে সবার পিসিতে বসে বসে দেখেন।

সেদিন তিনি খুব বেশি আমাদের রুমে আসেননি। দিনের শুরুতে এসে কিছু কাজের ইন্সট্রাকশন দিয়ে চলে গিয়েছেন। সারাদিন আর আসেননি। বিকেলে এসে বলে গিয়েছেন পরেরদিন আমাদের কাজ দেখবেন। আমরা চাইলে সেদিন চলে যেতে পারি। সবাই ভাবলো আজ তিনি খুব ব্যস্ত আছেন। আর, আমার মন বলছিলো অন্য কিছু।

সেই ঘটনার প্রায় ৭দিন পর তিনি যখন আমাদের কাজ দেখছিলেন তখন বললেন আমার কাজে কিছু ভুল হয়েছে। ভুলগুলো তিনি পরে ধরিয়ে দিবেন। আগে বাকিদের কাজ দেখবেন। তিনি বাকিদের কাজ দেখে বললেন তাঁকে কিছু জরুরি মেইল করতে হবে। আমার যদি খুব বেশি তাড়া না থাকে তবে আমি যেন অপেক্ষা করি। বাকিরা চাইলে চলে যেতে পারে। তিনি মেইল দিয়ে এসে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে কাজটা সম্পন্ন করবেন।

তাঁর আচার – আচরণ, কথাবার্তা এতোটাই স্বাভাবিক ভুলেও কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। বন্ধুরা বললো তাঁদের বাড়ি যেহেতু কিছুটা দূরে তাঁরা চলে যাবে। আমিও তাতে সায় দিলাম। তখনো পর্যন্ত তাঁর জন্য আমার মনে কোন সন্দেহ জাগেনি। বন্ধুরা বের হয়ে যাওয়ার পর তিনি আমার রুমে আসলেন। এসে বললেন তিনি আমাকে একটা কফি শপে নিয়ে যেতে চান। আমার যাবো কিনা!

তাঁর প্রস্তাব পেয়ে আমি রীতিমতো অবাক হলাম। কোনরকমে সামলে নিয়ে বললাম, ” আর আমার কাজটা ? ”

আরো পড়ুন : কিভাবে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়াবেন?

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন কাজে কোন ভুল নেই। এই সময়টা পাওয়ার জন্য তিনি তখন মিথ্যা কথা বলেছেন। এইজন্য তিনি অনুতপ্ত। এই ছাড়া তাঁর অন্য কোন উপায় ছিলো না। চাইলে আমি এর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারি।

সব কথা তিনি পরপর বলে গেলেন। তাঁর কথা বলার ধরণ দেখে আমি হাসলাম। রাগ হবে দূরে থাক, আমার কেন জানি খুব ভালো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার অবচেতন মন এমন কিছুই চাচ্ছিলো। আমার সাথে সময় কাটানোর জন্য কেউ এমন পরিস্থিতি তৈরী করেছে সেটা ভাবতে ভালো লাগছিলো। নিজেকে কোন রোমান্টিক সিনেমা এবং উপন্যাসের নায়িকা মনে হচ্ছিলো।

আমি মুচকি হেসে বললাম, “ব্যবস্থা পরে নিবো। এখন আমরা কফি শপে যাই। ”

তখনো অফিস ছুটি হয়নি। তবে ইন্টার্নদের জন্য নিয়ম অনেকটা শিথিল। আমি আগে নিচে নামলাম। তিনি পরে আসলেন। অফিসের সামনে থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে আমরা একটি রিক্সায় উঠলাম।

আজ আমার বিব্রত লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। মনের মধ্যে কেমন জানি শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। প্রেম প্রেম অনুভূতি হচ্ছে। খুবই সুন্দর একটি অনুভূতি। কিশোর ভাইয়ার জন্য আমার মনে এমন অনুভূতি কবে এবং কখন তৈরী হয়েছে জানি না। সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তাঁর সাথে রিক্সায় না উঠলে হয়তো বুঝতেও পারতাম না। সেইদিনের সেই মুহূর্তটা সকলকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে।

কেন জানি মনে হচ্ছে কিশোর ভাইয়ার অবস্থা আমার মতোই। কী লজ্জার কথা! ডাকছি ভাইয়া কিন্তু এইদিকে আবার ভালোবাসার কথা বলছি তাঁকে নিয়ে। রিক্সাতে পাশাপাশি বসে আছি। কেউ কোন কথা বলছি না। আমরা মুখে কোন কথা না বললেও আমাদের অনুভূতিরা কথা বলছে। অনুভূতিরা নিজেদের মধ্যে আদান প্রদান করছে। এক অদ্ভুত সুন্দর মুহূর্ত। যাদের জীবনে এমন মুহূর্ত এসেছে তাঁরা সঠিকভাবে ব্যাপারটা অনুভব করতে পারবে।

“কী ভাবছো ?” তিনি আগে কথা বললেন।

“কিছু না। ”

“শিওর ?”

“হ্যাঁ!”

“ঠিক আছে। ”

“আপনি কী ভাবছেন ?”

“অনেক কিছু। ”

“বলা যাবে ?”

“যাবে, আবার যাবে না। ”

“এটা আমার কেমন ?”

“কী জানি!”

তাঁর কথা বলার ধরণ দেখে মজা পাচ্ছিলাম। অফিসে তাঁর কথা বলার ধরণ আর এখনকার কথা বলার ধরণ একদম আলাদা। দুটি ভিন্ন মানুষ। এই ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। যস্মিন দেশে যদাচার।

রিক্সা এসে কফি শপে নামলো। আমরা ভেতরে ঢুকে একটি টেবিলে বসলাম। মোটামুটি ফাঁকাই আছে। একটু নিরিবিলি, কোলাহল কম জায়গায় আমার পছন্দ।

তিনি বসে সরাসরি আমার দিকে তাকালেন। একদম চোখের দিকে। আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকালাম। তারপর তিনি আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, “তুমি কি জানো আমি অন্য ধর্মের ?”

আরো পড়ুন : রেসিজম বলতে আসলে কী বুঝায়?

তাঁর প্রশ্নটা শুনে মনে হলো কেউ আমার কানের মধ্যে গরম তীর নিক্ষেপ করেছে। প্রচুর যন্ত্রনা হচ্ছে। আমি সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে এখনই আমার মৃত্যু হবে।

আমি তাঁর দিকে বিষাদ ভরা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছি। তবে ঠিক তাঁকে দেখছি না। দেখছি ধর্মের সীমারেখায় আটকে যাওয়া সদ্য ক্ষতবিক্ষত দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে।

আমার চোখ ভরে উঠলো পানিতে। যে কোন মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে। শুরুতে কিশোরের বলা “তুমি কি জানো আমি অন্য ধর্মের ?” এর পরে আমাদের সকল অনুভূতি এবং আলোচনা করাটাই বৃথা। আমরা আর সামনে আগালাম না। আমাদের সকল কথা এবং অনুভূতি সেই এক প্রশ্নেই আটকে গেলো।

গল্পটি লিখেছেন ফারজানা আক্তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *