অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলাম। ভেবেছিলাম সেই হয়তো তার ভালোবাসার কথা আমাকে আগে জানাবে, কিন্তু তা হয়নি। তিনি আমাকে পছন্দ করেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তার এপ্রোচ খুব আহামরি ছিলো সেটা বলা যাবে না। খুব বেশি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে তার এপ্রোচগুলো বুঝা যাবে না। মনে হবে খুব নরমাল। সাধারণ কর্মকান্ড।
পছন্দ যেহেতু আমিও তাকে করি তাই তার ছোটখাটো সকল কর্মকান্ড আমি খেয়াল করতাম। আমার এপ্রোচও তেমনই ছিলো। সবাই বুঝবে না, যে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে শুধু সেই বুঝবে। আমি যেভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করি, তিনিও সেভাবে আমাকে পর্যবেক্ষণ করেন। এটা আমার ধারণা নয়, বিশ্বাস। তিনি ছিলেন আমার ছোট ভাইয়ের গৃহশিক্ষক। গ্রামের ছেলে। পরিবারের সামর্থ্য নেই বেশি দূর পড়াশোনা করানোর। নিজের মেধার জোর আর পরিশ্রমের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। টিউশনি করে নিজে খরচ চালান এবং গ্রামে কিছু পাঠান।
তার পোশাক এবং চাল – চলন দেখে তার আর্থিক অবস্থা অনেকটাই টের পাওয়া যায়। কথাবার্তা এবং আচার – আচরণ দেখে পারিবারিক সু – শিক্ষা। তার ভদ্রতা এবং সভ্যতা দেখে আমার বাবা – মা পুরো তার ফ্যান হয়ে গিয়েছিলেন। আমার ছোট -ভাইকে আমার মা যতটা আদর করেন, ভালোবাসেন; মাঝে মাঝে মনে হয় তাকেও আমার মা ততটাই ভালোবাসেন। পড়াতে আসলে মা তার খোঁজ – খবর নেন। বাসার সেরা খাবারটা তাকে নাস্তা হিসেবে দেন। তবে, আমার বাবা – মায়ের পরিমিতিবোধ আছে। এমন কিছু করেন না বা বলেন না যেন তিনি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে যান বা ভাবেন তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তান তাই আমার পরিবার বেশি আদিখ্যেতা করছে বা দয়া দেখাচ্ছেন।
আরো পড়ুন : সম্পর্কে স্যরি বলা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উনার সাথে আমার তেমন কথাবার্তা হয়নি। দেখা হয়েছে অনেকবার। উনি কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিয়েছি। অথবা মা আমাকে দিয়ে চা পাঠিয়েছেন, দিয়ে এসেছি। ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি। পড়ানো শেষে চলে যাওয়ার সময় আব্বু তাকে বসতে বললেন গল্প করার জন্য। তিনি হয়তো তখন বসলেন। এমনভাবে দেখা হয়েছে। আর, কথা! উনার সাথে দেখা হলে উনি সালাম দেন। আমি সালামের উত্তর দেই। অথবা চা দিতে গিয়ে বলি মা পাঠিয়েছেন। তিনি ছোট্ট করে ধন্যবাদ দেন।
কিভাবে, কখন তাকে ভালোবেসে ফেলেছি বলতে পারবো না। তবে একবার তার মায়ের অসুস্থতার জন্য তিনি গ্রামে গিয়েছিলেন। হুট করে চলে যান। পরে মাকে নাকি ফোনে জানিয়েছিলেন। পরপর দুইদিন তাকে না দেখে ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। মনে হয়েছিলো আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা মিসিং। আমি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো বাতাসে যা ভেসে বেড়ায় সেটা আমার অক্সিজেন নয়, আমার অক্সিজেন কেউ একজন নরমসুরে সালাম দেয়; সেই কণ্ঠস্বরটা।
মায়ের ফোন থেকে চুপি চুপি তার নাম্বারটা নিলাম। তাকে কল দিলাম। আমার কল পেয়ে তিনি খুব অবাক হলেন। আমি আবার অতো ভণিতা করে কথা বলতে পারি না। তিনি যখন জানতে চাইলেন আমি কেন কল দিয়েছি! কিছু বলবো কিনা। আমি উনাকে সরাসরি বললাম, “আমি আপনাকে মিস করছি। আপনাকে দেখতে না পেয়ে আমার কেন জানি লাগছে। আপনার কণ্ঠস্বর শুনতে না পেয়ে আমার সাফোকেশন হচ্ছে। ”
তিনি মনে হয় একটু মিষ্টি করে হাসলেন। ফোনে দেখা যায় না, তবে অনুভূতি টের পাওয়া যায়। আমি তার অনুভূতি ঠিক টের পেলাম। মিষ্টি করে হেসে বললেন, “আপনি বড্ড সাহসী মেয়ে। এভাবে সরাসরি কোন ছেলেও হয়তো বলতে পারবে না। ”
আরো পড়ুন : ভালোবাসার সত্যিকারের সংজ্ঞা কী?
তার পজেটিভ এপ্রোচ দেখে আমি কিছুটা সাহস পেলাম। সাহস পেয়ে বললাম, “আপনার উচিত আমাকে এখন ধন্যবাদ দেওয়া। ”
– কেন?
– কারণ, আমি আপনার পথ অনেক সহজ করে দিয়েছি।
– যেমন ?
– এই যে আপনাকে আর কষ্ট করে আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে হবে না।
– আমি আপনাকে ভালোবাসি এই কথা কে বললো?
– আপনিই বলেছেন।
– কখন এবং কিভাবে ?
– বলেছেন মনে মনে আর অনেকবার বলেছেন। সময় লিখে রাখিনি।
তিনি তখন জোরে হাহাহা করে হেসে উঠলেন। সেই প্রথম তাকে আমি মন খুলে জোরে হাসতে শুনলাম। কল্পনায় তার অট্টহাসি দেখে নিলাম। তিনি জানালেন তার মায়ের অবস্থা কিছুটা ভালো। পরেরদিন তিনি ঢাকা ফিরবেন।
আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। মনে মনে কিছুটা লজ্জাও পাচ্ছিলাম। যদিও অতিরিক্ত আবেগে ফোনে গড়গড় করে কথা বলে গিয়েছি। এখন তার সামনে যেতে আমার লজ্জা লাগবে। যতই সাহস দেখাই, দিন শেষে আমি তো একজন মেয়ে। মেয়েদের কমন বৈশিষ্ট সবই তো আছে।
রাতে একটি মুভি দেখতে গিয়ে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। যথারীতি ঘুম থেকে উঠতেও অনেক দেরি হয়। আমি যখন ঘুম থেকে উঠি তখন প্রায় দুপুর। মাকে বলি এক কাপ কফি দিতে। দিচ্ছি বলে মা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময় মায়ের ফোনে একটা কল আসে। আমার ছোট ভাইয়ের সেকেন্ড সেমিস্টারের রেজাল্ট দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো ছোট ভাই কোন পরীক্ষায় প্রথম হলো। ছাত্র হিসেবে সে খুব একটা সুবিধার নয়। ১০ এর আগে তাকে কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। হুট করে তার বিশাল উন্নতি।
আরো পড়ুন : ভালোলাগা এবং ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কী?
আমার মা খুশিতে বাকবাকুম হয়ে ছোট ভাইয়ের শিক্ষক মানে উনার প্রশংসা করে যাচ্ছিলেন। তার প্রশংসার মাত্রা এতই যে মনে হচ্ছে পরীক্ষা ছাত্র নয়, শিক্ষকই দিয়েছেন। আমার আর কী! শুনতে ভালো লাগছে। আমার ভালোবাসার মানুষের এতো প্রশংসা আমার নিজের মা যখন করছেন তখন তো শুনতে ভালো লাগারই কথা।
কিছুক্ষণ পর বাবা ফোন করলেন। বাবা ফোন করে জানালেন আগের দিন রাতে গ্রামে প্রচন্ড ঝড় হয়েছে। গাছ – গাছালি ভেঙেচুরে একাকার। অনেক মানুষের ঘরের চাল উড়ে গেছে, অনেকের ঘর ভেঙ্গে পড়েছে। নদী – নালার পানি বেড়ে গিয়ে আশেপাশের জমিতে, বাড়িতে উঠে গিয়েছে।
বাবাকে ফোন করেছেন গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার রফিক চাচা। রফিক চাচার মাধ্যমেই তার সাথে বাবার পরিচয়। তিনি যখন ঢাকা আসবেন তখন রফিক চাচা বাবাকে ফোন করে বলেছিলেন তাকে কয়েকটা ভালো ভালো টিউশনি ম্যানেজ করে দিতে। রফিক চাচার মুখে প্রশংসা শুনে আব্বু নিজের ছেলের জন্যই তাকে আগে ফিক্সড করে ফেললেন। তারপর আমাদের বিল্ডিংয়েই তার আরো তিনটি টিউশনি ঠিক করে দিলেন। এমাউন্ড বেশ ভালোই দেয় সবাই। তাই অন্য কোথাও তাকে আর কোন টিউশনি খুঁজতে হয়নি। ছাত্র – ছাত্রী পড়াতে গিয়ে কোন বিড়ম্বনাতেও পড়েননি।
রফিক চাচার ভাষ্য অনুযায়ী; তার মানে আজান; আজান হচ্ছেন সেই মানুষটা যার গল্পই এতক্ষণ ধরে বললাম। আজানদের ঘরের পাশে একটা বটগাছ ছিলো। অনেক বয়স গাছটার। প্রবল ঝড়ে সেই গাছটা আজানদের ঘরের উপর ভেঙে পড়ে। ঘর থেকে কেউ বের হতে পারেনি। ঘরে ছিলো আজান, তার বাবা – মা, দুই বোন আর বড় ভাই এবং ভাবী।
আরো পড়ুন : গল্পটা আমার কিংবা কিশোরের!
কে কত সেকেন্ড আগে পরে মারা গিয়েছে সেটা আমরা কেউ জানি না। শুধু এটা জানি আজানসহ পুরো পরিবারের সবাই একইসাথে মারা গিয়েছে।
মা বাবার সাথে কথা শেষ করে যখন আমাকে কথাগুলো বলছিলেন আমি মায়ের কথা শুনছিলাম না, মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। আমার সেই ফ্যালফ্যাল করে তাকানো চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিলো। মা ভাবছে তার মেয়ে নরম মনের মানুষ। কষ্টের কথা শুনে কাঁদছে।
মা জানেন না তার মেয়ে একজন প্রেমিকাও। সদ্য ভালোবাসার মানুষ হারানোর শোকে কাঁদছে। এমন একজন মানুষের জন্য কাঁদছি যাকে পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেলেছি।
আচ্ছা! আমি কি তাকে হারিয়ে ফেলেছি? না; হারাইনি। সে মারা গিয়েছে, হারিয়ে যায়নি। মনের মধ্যে সে আছে এবং থাকবে।