সম্পর্কে মতবিরোধ / দ্বন্দ্ব ( Conflict) কিভাবে সামলাবেন?

couple-conflit

যে কোনো সম্পর্কে ঝগড়া, মান – অভিমান, তর্ক – বিতর্ক, মতবিরোধ সকল কিছুই থাকবে। এই সকল বিষয় থাকা মানে এমন নয় যে আপনি বা আপনার সঙ্গী সম্পর্কে অসুখী। বরং সম্পর্কে এই সকল বিষয় থাকা স্বাভাবিক। দুটি মানুষ দিনের পর দিন একসাথে থাকলে তাঁদের মধ্যে নানান বিষয় নিয়ে খুঁনসুটি হবে, মান – অভিমান হবেই।

সমস্যা হয়ে যায় তখন যখন সম্পর্কের যে কেউ একজন ভুলভাবে সেনসেটিভ বিষয়গুলোতে ভুলভাবে ডিল করে। যেমন মনে করুন দুইজন কোনো একটি বিষয় নিয়ে তর্ক করছেন। সেটা হতে পারে খুব সামান্য ইস্যু কিংবা বড় কোনো ইস্যু। তর্ক করার সময় একজন অন্যজনকে ননস্টপ দোষারোপ করে যাচ্ছেন। তখন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে আর?

মানুষের যখন মন মেজাজ খারাপ থাকে তখন সে সবথেকে বেশি ভুলভাবে সকল বিষয়ে ডিল করে। এবং বড় ধরণের সমস্যা শুরু হয় ঠিক তখন থেকে। যদি সঠিকভাবে আপনি মতবিরোধের সময়গুলো ডিল করতে পারেন তবে আপনার সম্পর্ক দিনে দিনে আরো বেশি মজবুত এবং সুন্দর হয়ে উঠবে।

মতবিরোধের সময় আপনি পরিস্থিতি কিভাবে হ্যান্ডেল করছেন সেটাই বলে দিবে আপনার সম্পর্ক মজবুত, নাকি নড়বড়ে। আজ আমরা সম্পর্কে মতবিরোধ /দ্বন্দ্ব ( Conflict) কিভাবে সামলাবেন সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। আপনার পরবর্তী মতবিরোধে কাজে লাগাতে পারবেন।

আরো পড়ুন: সম্পর্কে কন্ট্রোল ( CONTROL) এবং কেয়ারের ( CARE) মধ্যে পার্থক্য কী?

১। সুস্থ আলোচনা করুন:

সম্পর্কে যতই জটিল কোনো ঘটনা ঘটে যাক না কেন সুস্থ আলোচনা করুন। যে কোনো ঘটনার জন্য হতে পারে সেটি ছোটো কিংবা বড় আলোচনার জায়গা রাখুন। দুজন মুখোমুখি বসে শুধু সমস্যা নিয়ে নয়, সমাধান নিয়ে; এমনকি যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার ভালো – মন্দ দুটি দিক নিয়েই কথা বলুন। আপনি যদি আপনার সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে না পারেন, কোনো বিষয় নিয়ে মন খুলে কথা বলতে না পারেন তবে আপনি ভুল সম্পর্কে আছেন; অথবা আপনার সঙ্গী হয়তো ভুল সম্পর্কে আছে। দুজনকে সকল বিষয়ে সহমত হওয়ার প্রয়োজন নেই; কিন্তু ভিন্ন মতকে সম্মান করার মানসিকতা থাকতে হবে।

২। জটিল পরিস্থিতিতে শান্ত থাকুন এবং সঙ্গীর প্রতি সম্মান বজায় রাখুন:

অনেক সময় পরিস্থিতি খুব জটিল হয়ে যায়। দুজন দুজনের মতো চিৎকার – চেচাঁমেচি করে এঁকে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে। অভিশাপ দিতে থাকে এবং কখনো কখনো নোংরা গালাগালি এবং মারামারি পর্যন্ত বিষয়গুলো চলে যায়।

পরিস্থিতি যাই হোক আমাদের কোনো সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয়। পরে নিজেরই আবার অনুতাপ হবে। প্রথমত সম্পর্কে সমস্যা, পরবর্তীতে আবার নিজের মনে অনুতাপ; এতো মানসিক চাপ নেওয়া সম্ভব? তাই প্রথম জটিলতায় যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। কথা বলার সময় সঙ্গীর প্রতি সম্মান বজায় রাখুন। আপনি যদি শান্ত থাকেন এবং তির্যক বাক্য ব্যয় না করে চুপ থাকেন; তবে আপনার সঙ্গী একা বেশিক্ষণ চিৎকার – চেঁচামেচি করতে পারবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনিও চুপ হয়ে যাবেন।

৩। সমস্যা বুঝার চেষ্টা করুন:

অনেক সময় মনে হতে পারে আপনার সঙ্গী অযথা অভিমান করেছে বা রাগ করেছে। আপনি রাগ করার মতো বা অভিমান করার মতো কিছু করেননি। আসলেই কী, তাই? কখনো ভেবে দেখেছেন হুট করে কেন আপনার সঙ্গী আপনার সাথে রাগ করেছে কিংবা অভিমান করেছে?

এমনও তো হতে পারে তিনি হয়তো আপনার থেকে একটি বেশি এটেনশন চাচ্ছে কিংবা বাইরে যেতে চাচ্ছে অথবা আপনার কাছ থেকে আরেকটু বেশি সময় আশা করছেন। কখনো কখনো মানুষ চায় তাঁর সঙ্গী চাওয়াটা বুঝে নিবে, সে মুখে কিছু বলবে না। এখন আপনি হয়তো বলবেন আপনি মাইন্ড রিডার না; কেউ মুখে কিছু না বললে আপনি কিভাবে বুঝবেন? আপনার যুক্তি ঠিক আছে, কিন্তু একবার তাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাবুন তো! মাঝে মাঝে আপনারও এমন ইচ্ছে হয় কিনা! যে আপনি মুখে কিছু বলবেন না। আপনি চাচ্ছেন আপনার সঙ্গী যেন বুঝে নেয় তাঁকে আপনার প্রয়োজন।

সবসময় নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবলে হবে না। কখনো কখনো অন্যের জুতাতে পা রেখে জুতা এবং পায়ের মাপের ব্যাপারটা বুঝে নিতে হবে।

আরো পড়ুন: ভালোলাগা এবং ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কী?

৪। আপনার সঙ্গী কন্ট্রোল করছে, নাকি কেয়ার করছে সেটা বুঝার চেষ্টা করুন:

ভালোবাসা এবং কেয়ারের নাম করে অনেকে সঙ্গীকে কন্ট্রোল করতে চায়। যেমন অনেকে তাঁর সঙ্গী কোন বন্ধুর সাথে মিশবে, কার সাথে কতক্ষণ কথা বলবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়ে বন্ধু কিংবা ছেলে বন্ধু রাখবে, নাকি রাখবে না সব ঠিক করে দেয়। এমনকি কে কখন কোন পোশাক পরবে, কখন কোন খাবার খাবে থেকে শুরু করে সঙ্গীর জীবনের সকল সিদ্ধান্ত সে নিজেই দেয়। এর নাম আবার দেওয়া হয়েছে কেয়ার।

আপনি যদি আপনার সঙ্গীর মধ্যে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য দেখতে পান; তবে বলবো এখনই সতর্ক হন। তাঁর সাথে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন। প্রয়োজনে কাপল কাউন্সেলিং করুন। কন্ট্রোলিং যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। শুরুতে ভালো লাগলেও কিছুদিন পর দম আটকে যাবে। সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট হবে।

৫। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখুন:

মনে করুন আপনি এবং আপনার সঙ্গী এমন কিছু বিষয় তর্ক করছেন যেখানে আপনারা দুজনেই সঠিক। আপনি আপনার জায়গা থেকে ছাড় রাজি নন, আপনার সঙ্গীও তাঁর জায়গা থেকে ছাড় দিতে রাজি নয়। সেক্ষেত্রে করণীয় কী?

আগে ভেবে দেখুন আপনারা দুজন একসাথে শান্তিতে সংসার করতে চান কিনা! যদি আপনাদের উত্তর হয় আপনারা একসাথে শান্তিতে সংসার করতে চান কিংবা সুন্দর একটি সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চান তবে সেইক্ষেত্রে একটু এডজাস্ট করুন। এডজাস্ট শুধু একপক্ষ করবে না। দুজনেই করবেন। যেমন মনে করুন আপনি চান মাঝে মাঝে অফিস থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন। কিন্তু আপনার সঙ্গী চায় অফিস থেকে সোজা বাসায় এসে তাঁকে সময় দিবেন কারণ সে সারাদিন সংসার সামলিয়ে আপনার জন্য অপেক্ষা করে। এই ক্ষেত্রে আপনি সপ্তাহের একটি রুটিন বানিয়ে নিবেন। দুদিন কিংবা তিনদিন বন্ধুদের সাথে সময় কাটাবেন। বাকি সময়টা আপনার সঙ্গীকে দিবেন। আবার, যদি আপনার সঙ্গীর কোনো চাওয়া – পাওয়া যদি এমন হয় তাঁকেও একই সুযোগ দিবেন। এতে করে সংসারকে কখনো বোঝা মনে হবে না। সম্পর্কে দূরুত্ব তৈরী হবে না।

সম্পর্কে মতবিরোধ / দ্বন্দ্ব
সম্পর্কে মতবিরোধ / দ্বন্দ্ব

৬। মাঝে মাঝে দ্বিমত থাকলেও এড়িয়ে যান:

সবসময় সঙ্গীর সাথে দ্বিমত হলেই তর্ক করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কখনো কখনো এড়িয়ে যাবেন। এই ক্ষেত্রে আপনাকে কিছুটা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে কখন আপনি তর্ক করবেন আর কখন এড়িয়ে যাবেন এটা নিজ দায়িত্বে বুঝে নিতে হবে। আপনার অপছন্দের রেসিপি খাবার টেবিলে দেখে যদি আপনি সঙ্গীর সাথে তর্কে জড়িয়ে যান; বুঝতে হবে আপনি সুস্থ সম্পর্কে নেই। আপনার সাহায্যের প্রয়োজন।

৭। সিরিয়াস ইস্যুগুলো সমাধান করে সামনে এগিয়ে যান:

অনেক সময় বড় কোনো ইস্যু সামনে এলে আমরা বলি আপাতত এইভাবে চলুক। পরে দেখা যাবে। কিন্তু পরে কী দেখা যায়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভাঙ্গন অথবা অশান্তি। যেমন সম্পর্কের শুরুতে কিংবা বিয়ের আগে দুজনের ফিলোসফি ভিন্ন হলেও দুজন দুইজনকে মেনে নেয়। শহর আলাদা হলেও কিংবা চাকরিসূত্রে দূরে থাকার প্রয়োজন হলেও কেউ তেমন সমস্যা দেখে না। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো একজনের জন্য অন্যজনকে হয়তো একটু বেশি ছাড় দিতে হয় কিংবা দেয়ও; কিন্তু তবুও কোথায় যেন ছন্দপতন হয়ে যায়।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ইস্যুগুলো পরবর্তীতে বিরাট সমস্যার কারণ হতে পারে সেগুলো আগের যতটা সম্ভব সমাধান করা উচিত। ভবিষৎ আমরা কেউ জানি না। কিন্তু ব্যাসিক কিছু ব্যাপার থাকে। যেগুলো আজ কিংবা কাল যে কোনো সময় বড় সমস্যা হতে পারে। সেই বিষয়ে সকলের সচেতন থাকা উচিত।

সবার সম্পর্ক সুন্দর হোক। সবাই সুখী হোক। সকলের জন্য দোয়া এবং ভালোবাসা।

এই আর্টিকেলটি লিখেছেন ফারজানা আক্তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *