Stories in Bengali: মেয়েটা কার?

short-story

– বৌদির অহন খবর কী?

– বেশি ভালা না। সারাদিন ঝিম মাইরা বইয়া থাহে। এক কতা তিনবার জিগাইলে একবার জবাব দেয়। রাইতে গুমায় না। উপরের দিকে তাকাইয়া কী জানি ভাবে!

– তোর অহন বৌদির কাছাকাছি থাহন দরকার। কহন কী হয়! বিপদের আবার হাত পা নাই।

মাটি কাটার ফাঁকে বিঁড়ি ফুকতে ফুকতে গণেশ আর জমির কথা বলছে। দুইজন বাল্যকালের বন্ধু। একই গ্রামে জন্ম, বয়সও কাছাকাছি। কাছাকাছি পাড়ায় থাকে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত একইসাথে পড়েছে। তারপর দুইজনে একসাথে কাজে নেমে পড়েছে।

যে কাজই করে দুইজন একইসাথে করে। কাজ শেষে একইসাথে বাড়ি ফিরে, একইসাথে আড্ডা দেয়। তাদের সবই এক, শুধু ধর্মটা আলাদা।
যদি ধর্মটা এক হতো তবে দুইজন একই পরিবারের দুইবোনকে বিয়ে করতে। এক পরিবারের দুই বোন বিয়ের উপযুক্ত না হলে তারা বিয়েই করতো না। মনে মনে দুইজন এমনই চিন্তা ভাবনা করে নিজেদের অজান্তে হেসে ফেলে। একই পরিবারে বিয়ে না করলেও দুইজন একই বছরের একই মাসে বিয়ে করেছিলো। একজন বিয়ে করে আগষ্ট মাসের ১২ তারিখ, অন্যজন আগষ্ট মাসের ১৬ তারিখ।

গণেশের পরিবারে কেউ নেই৷ জন্মের আগেই বাবা মারা যায় আর তার বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখন তার মা মারা যায়। জমিরের বাড়িতে খেয়ে, তার সাথে মিশেই বড় হয়েছে এবং মানুষ হয়েছে।

জমিরের সংসারে এখন তার বউ ছাড়াও মা, ছোট ভাই এবং ডিভোর্সি বোন রয়েছে। সাথে ডিভোর্সি বোনের একমাত্র মেয়েও আছে।
দুইজনের আয় সমান কিন্তু ব্যয় জমিরের বেশি। তাই গণেশ মাঝে মাঝে এই বাহনায়, ওই বাহনায় জমিরের বাড়িতে বাজার সদাই পাঠিয়ে দেয়।
একবার হয়েছে কী! কাজ থেকে ফেরার সময় দুইজন বাজারে ঢুকলো। কিছু তাজা কই মাছ দেখে জমির দাম জিজ্ঞেস করলো। মাছের দাম শুনে জমিরের মুখটা শুকিয়ে গেলো। মাছওয়ালা এক কেজি কই মাছের যা দাম চেয়েছে তা দিয়ে প্রায় ১ সাপ্তাহের আলু, মুসুর ডাল কেনা যাবে।

আরো পড়ুন: ছোটগল্প: পত্রমিতালী

 

জমিরের বাড়িতে বেশিরভাগ রান্নার আয়োজনে থাকে ঝাল ঝাল আলু ভর্তা, পুকুর ডোবার পাশে অযত্নে বেড়ে উঠা কলমি শাক, ক্ষেতের পাশে নিজ ইচ্ছেতে জন্মানো হেলেঞ্চা শাক এবং নামমাত্র মুসুর ডাল দিয়ে রান্না করা পানির মতো পাতলা ডাল।

জমির মাছের কাছ থেকে সরে গিয়ে আলু, ডিম, পেঁয়াজ, খোলা তেল এসব কিনে নিলো। অন্যদিকে গণেশ দেড় কেজি কই মাছ কিনে বাড়ি গেলো। কয়েকটা মাছ নিজেদের জন্য রেখে বাকি মাছগুলো নিয়ে জমিরের বাড়িতে গেলো। মাছ দেখে জমির বুঝে গেছে কাহিনি কী! সে মাছের দাম শুনে কিনে নাই এই কথা গণেশের থেকে আর ভালো কে বুঝবে!

জমিরের মা মাছ দেখে অবাক। জিজ্ঞেস করলো এই মাছগুলো কেন নিয়ে এসেছে! গণেশ হেসে জবাব দিলো, ” মা, তোমার হাতের কই মাছের তেল ঝাল খাইতে মন চাইছে। তাই লইয়া আইলাম৷ তুমি তাড়াতাড়ি রান্ধো৷ তুমি রানলে আমি ভাত খামু। ”

জমিরের মা হাসেন। তিনি জানেন গণেশ মিথ্যে বলছে। নিশ্চয় আজ গণেশ তার বাড়ির জন্য মাছ কিনেছে। তাই তাদের জন্যও কিনে এনেছে। জমিরের পক্ষে মাছ, মাংস কেনা সম্ভব হয় না। গণেশের কারণেই তাদের পরিবারে মাঝে মাঝে মাছ আর মুরগীটা আসে।

গণেশ জমিরের মাকে মা বলে ডাকে। তার মা চলে যাওয়ার পর এই মা তাকে আগলে রেখেছে। মায়ের মতোই যত্ন নিয়ে খায়িয়েছেন। অন্যের ধর্মের বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি। উনার চোখে গণেশ কিংবা জমির আলাদা নন।

দুই পরিবারের বন্ধন খুব গভীর, কিন্তু কেউ কারো ধর্ম নিয়ে কোন কথা বলে না। দুই পরিবারই দারিদ্র্যতার সাথে বসবাস করে। টানাটানি চলে উভয় পরিবারে, মান – অভিমান আছে, আছে অনুযোগ এবং অভিমানও; নেই শুধু ধর্ম বিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা কুসংস্কার।

আরো পড়ুন: গ্রীক মিথোলজি নিয়ে সেরা কয়েকটি বইয়ের তালিকা।

 

তাদের মধ্যে পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও আছে গভীর জীবনবোধ, সামাজিকতা, মানবতা এবং আত্মমর্যাদা। যে মর্যাদার কারণে তারা জানে অন্যের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে; দিনশেষে নিজের ধর্মকেই ছোট করা হয়৷ তাই নিজের ধর্মের সম্মান ধরে রাখতে হলে অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখানো জরুরি।

তারা জানে অন্যের ভালোবাসা পেতে হলে আগে অন্যকে ভালোবাসতে হবে। জমিরের মা যেমন গণেশকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, আজ গণেশ তেমনি সন্তান হয়ে মায়ের প্রতি তার দায়িত্ব পালন করছে।

………

– ভাবীর শরীরের কী অবস্থা?

– ও ভালা আছে। গতকাল মা হাসপাতালে লইয়া গেছিলি। ডাক্তার আপায় নাকি কইছে সবই ঠিকঠাক আছে।

– আমরা দুইজন তাইলে এক লগে বাবা হইতাছি?

– হাহাহাহাহা! তুই ভগবানের কাছে কি চাস? আমি আল্লাহর কাছে একটা মাইয়া চাইছি।

– পয়লা সন্তান। সুস্থ হোক এডাই চাই। পোলা, মাইয়া লইয়া আমার সমস্যা নাই।

– তুই অনেক সুন্দর চিন্তা করোস। আমরা কাছাকাছি বয়সের। তবুও তোর মতোন আমি চিন্তা করবার পারি না।

– হাহাহা! কী কস! আয় কাম তাড়াতাড়ি শেষ করি। বউডা বাড়িতে একা আছে। তাড়াতাড়ি যাওন লাগবো।

– হ! আয়।

গণেশের বউ অর্পিতার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। সেই গর্ভবতী হওয়ার প্রথম মাস থেকে নানান ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিছুই খেতে পারে না। এই অবস্থায় প্রথম দিকে কিছু খেতে না পারা, খেলে বমি করে দেওয়া ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু অর্পিতা তার পুরো জার্নিতে পেট ভরে, তৃপ্তি করে কিছুই খেতে পারলো না। কিছু মুখে নিলেই বমি করে দেয়।

সবকিছুতেই সে গন্ধ পায়। খাবার দেখলে তার বমি আসে। তাছাড়া সারাক্ষণ মাথায় ব্যথা, পেটে ব্যথা তো আছেই। মাঝে মাঝে তার মনে হয় সে নরকে আছে। নরকের শাস্তি ভোগ করছে।

আরো পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের পাঠকপ্রিয় ১৩০টি সেরা উপন্যাসের তালিকা।

আজ রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। পাশের ঘরের নন্দা দেখে মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে শুয়িয়ে দিলো। তখন পেটের ব্যথা বেড়েছে দ্বিগুণ। গণেশ কাজ থেকে ফিরে অর্পিতার এই অবস্থা দেখে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলো।
পাড়ার নান্টুকে দিয়ে গণেশ জমিরকে খবর পাঠায়। জমির তখন চাপ টিউবওয়েলে পানি চেপে গোসল করছিলো। নান্টু খবরটা দেওয়ার সাথে সাথে জমির তার বউ সাথীকে ডেকে দ্রুত তার শার্টটা দিতে বললো। সাথী দৌঁড়ে ঘরে গিয়ে জমিরের শার্টটা নিয়ে টিউবওয়েলের পাড়ে আসার সময় ঘরের দরজার সামনে রাখা একটা উঠান ঝাড়ুর সাথে উষ্ঠা খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যায়।

সাথী পড়ে গিয়ে ” ও মাগো! ” বলে একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। জমির সাথীর চিৎকার শুনে দৌঁড়ে আসে। জমিরের মা, বোন সবাই ছুটে আসে। দ্রুত একটা ভ্যানগাড়ি ম্যানেজ করে জমির তার বউকে নিয়ে ছুটে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দিকে।

সব এতো দ্রুত ঘটে গেলো। কারো মাথায় কিছু ঢুকছে না। কারো মাথা কাজ করছে না। সব কেমন দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। এই অবস্থায় কে কাকে সান্ত্বনা দিবে!

দুইজনের অবস্থা এক। একজন তার আল্লাহকে ডেকে যাচ্ছে, অন্যজন তার ভগবানকে। দেখা যাক কে আগে সাড়া দেয়!

প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তার এসে জানালো জমিরের বাচ্চাটা পেটেই মারা গেছে। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে এখন মরা বাচ্চাকে বের করতে হবে।

জমির যখন অঝোরে কাঁদছে ঠিক তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে গণেশ। বন্ধুর কষ্টে সেও কাঁদছে। তার একটু পর ডাক্তার এসে জানালো গণেশের একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে। তবে গণেশের বউকে তারা বাঁচাতে পারেনি। সন্তান জন্ম দিয়ে মা মারা গিয়েছেন।

মূহুর্তে গণেশ কাঁদতে ভুলে গেলো। বন্ধুর নির্বাক হওয়া দেখে জমিরও নির্বাক হয়ে গেলো। তারা দুইজন কাঁদতে ভুলে গেলো।
এ কেমন নিষ্ঠুরতা! এ কেমন নিয়তি!

এখানে কার কষ্টটা কম, আর কার কষ্টটা বেশি? কে কাকে সান্ত্বনা দিবে? কে কার পাশে দাঁড়াবে? কার দুঃখ নিরাময়ের সাথী কে হবে?
জীবনের হিসাব নিকাশ বড়ই নিষ্ঠুর।

আরো পড়ুন: ছোটগল্প : আমার অপূর্ণ প্রেম।

 

কিছুক্ষণ পর গণেশ রোবটের মতো হেঁটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। তারপর জমিরকে ডাকলো। জমির এগিয়ে গেলে গণেশ অর্পিতার একটা হাত টেনে বাচ্চাটার গায়ের উপর রাখলো। তারপর জমিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ” আমাগো বাচ্চাডা আজ থেইক্যা তোগোরে দিলাম। বিনা দাবিতেই দিলাম। তোগো পরিচয়ে বড় অইবো আমাগো সন্তান। ”

জমির অবাক হয়ে বাচ্চাটা কোলে দিয়ে কোন রকমে তোতলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” আ-র ধ-র্ম?”

গণেশ উত্তর দিলো, ” তোরা যে ধর্মের তোগো সন্তান ওই ধর্মের অইবো। এইডা জিগানের কী আছে!”

জমির একহাতে বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে অন্য হাতে গণেশকে জড়িয়ে ধরলো। দুই বন্ধু কাঁদছে। অঝোরে কাঁদছে। একটু দূরে দাঁড়ানো নার্সটাও কাঁদছে। ভিন্ন ধর্মের দুই বন্ধুর এমন মহানুভবতা সেই নার্স তার চাকরি জীবনের এই ২০ বছরে কখনো দেখেনি।
ওইদিকে স্বর্গের পথে পাড়ি জমানো অর্পিতা কি জানে সাথী এবং জমির তাদের মেয়ের নাম রেখেছে অর্পিতা!

আচ্ছা! মেয়েটা আসলে কার?

গল্পটি লিখেছেন ফারজানা আক্তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *