মুড সুইং কী? কেন হয় এবং কখন হয়? এর থেকে মুক্তির উপায় কী? 

মুড সুইং বিষয়ে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। এটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই হতে পারে মুড সুইং। এই ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীদের মুড সুইং বেশি হয়। মুড সুইং কিন্তু শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো রোগ নয়; এটি শুধুমাত্র মানুষের বিশেষ এক মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়।

একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যাদের ঘনঘন মুড সুইং হয় তাঁদের মস্তিস্ক খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যে কোনো সমস্যার সমাধান অন্যদের তুলনায় দ্রুত করতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যবশত, এটি সকলের ক্ষেত্রে হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘনঘন মেজাজ বিগড়ে যাওয়া কিংবা মুড সুইং বিপদজনক হয়ে ওঠে।

এই আর্টিকেলে আজ আমরা যে সকল বিষয় সম্পর্কে জানবো তা হলো:

– মুড সুইং কী ?

– মুড সুইং-এর কারণসমুহ।

– মুড সুইং-এর লক্ষণসমুহ এবং

– মুড সুইং নিয়ন্ত্রণের উপায়সমুহ।

আরো পড়ুন: Stories in Bengali: মেয়েটা কার?

মুড সুইং কী?

আপনি দেখবেন কিছু মানুষ রয়েছে তাঁরা হাসছে, কথা বলছে, গল্প করছে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে হুট করে কোনো কারণ ছাড়াই রেগে যাবে, চিৎকার – চেঁচামেচি করবে, মন খারাপ করবে, কান্নাকাটি করবে, হতাশ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে; চোখের পলকে কী থেকে কী হয়ে যাবে আপনি কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না।

চোখের পলকে আবেগের এই পরিবর্তনকে মুড সুইং বলা হয়। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ মানুষ অন্যের মুড সুইংকে ন্যাকামি বলে উড়িয়ে দেয়। এটি মোটেই ঠিক নয়। ইচ্ছে করে কেউ এই হাসবে এবং এই কাঁদবে না। মুড সুইং চলার সময় বেশিরভাগ মানুষ বিনাকারণে সকল বিষয়ে ওভার রিএক্ট করে। এই ওভার রিএক্ট কেন করে তাঁরা নিজেরাও জানেন না। বুঝতে পারেন না। তাঁদের সেইসময় কোনো সেন্স কাজ করে না।

যে বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ আগে আনন্দ করে, কিছু সময়ের ব্যবধানে সেই একই বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে কিংবা মেজাজ দেখায়। সোজা কথায় এটিই মুড সুইং।

মুড সুইং এর কারণসমুহ:

মুড সুইংয়ের নির্দিষ্ট কোনো কারণ বলা মুশকিল। নানান ধরণের জটিলতার কারণে মুড সুইং তৈরী হয়। এমনই কিছু কারণ উল্লেখ করছি। যেমন:

হরমোন:

হরমোনের কারণ নারী এবং পুরুষ উভয়ের মুড সুইং হতে পারে। হরমোন মানুষের জৈবিক এবং আচরণগত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। যখন হরমোনের তারতম্য ঘটে তখন মুড সুইং হতে পারে। বিশেষ করে বয়সন্ধিকালে, মেয়েদের পিরিয়ডের সময়, গর্ভাবস্থায় হরমোনের তারতম্য বেশি দেখা যায়।  এই সময় খুব ঘনঘন মেয়েদের মুড সুইং হয়। পিরিয়ড শুরুর আগে মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ যৌন হরমোনের প্রভাবে প্রি মেন্সুয়্যাল সিনড্রোম দেখা দেয়। এই সময় ইমোশনাল ব্রেকডাউন সৃষ্টি হয়। তখন মেজাজ মর্জি ভালো কম, খারাপ বেশি থাকে।

এই সময়টা মেয়েদের জন্য কঠিন। কারণ এই সময়ে মেয়েরা তীব্র মুড সুইং – এ ভুগে। বয়সন্ধিকালে ছেলে মেয়ে উভয়েই ব্যাপক শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। তখন তাঁরা অল্পতে খুশি হয়, আবার অল্পতে দুঃখ পায়। অল্পতে স্বপ্ন দেখে এবং অল্পতেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। এটিও কিন্তু মুড সুইং- এর অন্তর্ভুক্ত। অল্প বয়সের আবেগ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

পুষ্টিহীনতা:

পুষ্টি শুধু শরীরকে ভালো রাখে এই ধারণা ভুল; পুষ্টি শরীর এবং মন উভয়ের জন্যই উপকারী। শরীরে যখন পুষ্টির অভাব দেখা দেয় তখন এর প্রভাব মনেও পড়ে। তখনো ঘন ঘন মুড সুইং দেখা দেয়।  ভিটামিন,আয়রন ও খনিজ পদার্থের অভাবে মুড সুইং হতে পারে। মেয়েদের যখন পিরিয়ড চলে তখন রক্তক্ষরণের অভাবে আয়রনের অভাব দেখা দেয়। আয়রনের অভাবে মুড সুইং দেখা দেয়। মুড সুইং এড়াতে পুষ্টির দিকেও নজর দিতে হবে।

আরো পড়ুন: Bangla Quotes About Life – মোটিভেশনাল উক্তি

 

অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলে:

আপনার যদি শরীর ভালো না থাকে তবে মনও ভালো থাকবে না। কেউ কোনো রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর দেহের স্বাভাবিক রাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ বাধাগ্রস্ত হয়। এই সময় তাঁর দেহের হরমোনেরও পরিবর্তন হয়। হরমোনের পরিবর্তন হলে মুড সুইং দেখা দেয়। তাছাড়া অসুস্থ অবস্থায় মানুষ বিভিন্ন ধরণের মেডিসিন কিংবা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও মুড সুইং হতে পারে।

ডিপ্রেশন:

আপনি যদি কোনো কারণে মানসিক চাপে থাকেন তখন সেই চাপ আপনার মন ও মস্তিস্ককে নানানভাবে প্রভাবিত করে। সেই সময় ডিপ্রেশনের মুখোমুখি হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মুড সুইং- এর অন্যতম একটি কারণ এবং লক্ষণ হলো ডিপ্রেশন।

অনিয়মিত ঘুমের অভ্যাস:

অনেকের ঘুমের সমস্যা রয়েছে এবং অনেকে আবার সারারাত ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে পারে না। অথবা রাতের ঘুম রাতে না ঘুমিয়ে দিনে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুমের অভাবে অথবা অনিয়মিত ঘুমের কারণে মুড সুইং হয়। ছোট বড় সকলের নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ঘুমানো উচিত। ঘুমের অভাবে শরীরে ক্লান্তি ভর করে এবং বিষণ্ণতা গ্রাস করে নেয়। তীব্র হতাশা এবং বিষণ্ণতা মুড সুইংয়ের অন্যতম কারণ।

মাদকাসক্তি:

মাদক সেবন শরীর এবং মনের জন্য বেশ ক্ষতিকর। মাদক শারীরিক, মানসিক এবং দেহের অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে। এটিও মুড সুইং – এর অন্যতম কারণ। মাদকাসক্ত ব্যক্তির মারাত্মক রকমের মুড সুইং হয়। মাদক গ্রহণ এবং মদ্যপান উভয়ই মুড সুইং – এর অন্যতম কারণ।

মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপ:

মাত্রাতিরিক্ত কাজের চাপও মুড সুইং – এর অন্যতম কারণ। যারা একটানা কাজ করেন তাঁরাও মুড সুইং – এর শিকার হন। বিরতিহীনভাবে একটানা কাজ করলে ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে গেলে বিষণ্ণতা ভর করে। তখনই মুড সুইং হানা দেয়।

এলোমেলো জীবনযাপন :

এলোমেলো জীবনযাপন মুড সুইং – এর অন্যতম আরেকটি কারণ। আপনি নিয়মিত খাবেন না, ঘুমাবেন না, গোসল করবেন না; তবে জেনে রাখুন খুব শীগ্রই আপনার মুড সুইং- এর সাথে দেখা হবে।

আরো পড়ুন: 50+ Quotes Bengali – মোটিভেশনাল উক্তি

 

মুড সুইং এর লক্ষণসমূহ:

পুরুষ বা নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই মুড সুইং এর সময়- হঠাৎ রেগে যাওয়া, কান্নাকাটি করা, বিষন্নতা, ডিপ্রেশন বা অবসাদ, হতাশা, উদ্বেগ বা এনজাইটি ইত্যাদি লক্ষণ গুলো লক্ষ্য করা যায়। মুড সুইং বলতে আমরা আবেগের এই তৎক্ষণাৎ নাটকীয় পরিবর্তনকেই বুঝি।

অকারণে রেগে যাওয়া:

যখন কোনো ব্যক্তি অকারণে অথবা খুবই সামান্য কোনো কারণে রেগে যাবে তখন বুঝবেন তাঁর মুড সুইং রয়েছে। মুড সুইং – এর সময় মানুষ খুব সামান্য ব্যাপারেও ওভার রিএক্ট করে।

কান্নাকাটি করা:

বিশেষ করে মেয়েরা পিরিয়ডের সময় কিংবা গর্ভকালীন সময় সামান্য ব্যাপার নিয়ে রিএক্ট করে এবং ব্যাপক কান্নাকাটিও করে। কান্না করার মতো ব্যাপার না হলেও তাঁরা কান্নাকাটি করে। এই লক্ষণগুলো দেখলে বুঝে নিবেন তাঁরা মুড সুইং – য়ে আছে। এই সময় রেগে না গিয়ে সহানুভূতিশীল হন।

বিষন্নতা:

যখন যুক্তিহীন কোনো ব্যাপারে আপনার বা আপনার আশেপাশের কারো মন খারাপ হবে; বুঝে নিবেন আপনি কিংবা সেই ব্যক্তি মুড সুইং – এ ভুগছেন।  এই সময় ব্যক্তিভেদে এবং তাঁর পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে বিষণ্ণতা কম – বেশি হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণত প্রে-মেনস্ট্রুয়াল সিন্ড্রমের সময় হরমোনের তারতম্যের কারণে এটি বেশি ঘটে।

ডিপ্রেশন:

আপনি কোনো কারণে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করছেন, কোনো কাজে মন দিতে পারছেন না, না চাইতেও অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে ফেলছে; তাহলে আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। মুড সুইং – এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ডিপ্রেশন। আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন মানে মুড সুইং-এর সাথে বসবাস করছেন।

হতাশা:

জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন মানুষ হাল ছেড়ে দেয়; সে ধরে নেয় তাঁকে দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা ব্যক্তিরা মুড সুইং – এর শিকার।

mood-swing
mood-swing

 

মুড সুইং নিয়ন্ত্রণের উপায়সমুহ:

মুড সুইং শুধুমাত্র মানুষের সাময়িক মানসিক অবস্থা। এটি কোনো রোগ নয়। তাই এর কোনো চিকিৎসাও নেই। তবে কিছু বিষয় মেনে চললে আপনি মুড সুইং থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন।

ব্যায়ামের অভ্যাস করুন:

নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, এক্সারসাইজ, ফিজিক্যাল মুভমেন্ট ইত্যাদি মুড সুইং নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ব্যায়ামের সময় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন নামক একটি রাসায়নিক বস্তু নিঃসৃত হয় যা মানুষের মনে প্রশান্তি যোগায় এবং মুড সুইং- এর জন্য দ্বায়ী ক্ষতিকর হরমোন নিঃসরণে বাধা প্রদান করে। আপনি যদি মুড সুইং নিয়ন্ত্রণ করতে চান তবে নিয়মিত ব্যায়ামের অভ্যাস করুন এবং পাশাপাশি সকালে এবং বিকেলে কিছুক্ষণ হাঁটার অভ্যাস করুন। নিয়মিত হাঁটা শরীর এবং মনের সুস্থতার জন্য বেশ উপকারী।

সুষম খাদ্যাভ্যাস:

শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে চাইলে সুষম খাদ্যের বিকল্প নেই। যেহেতু শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা মুড সুইং – এর জন্য দ্বায়ী, তাই মুড সুইং – কে দূরে রাখতে চাইলে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকা জরুরি।  নিয়মিত এবং উপযুক্ত পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ ,ভিটামিন ও খনিজ লবণ যুক্ত সুষম খাদ্য গ্রহণ করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে । ভিটামিন ডি ও ডি যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে , হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ভিটামিন ডি এর অভাব থাকে।

মেয়েদের পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে লৌহের পরিমাণ কমে যায়। সেই কারণে লৌহ সমৃদ্ধ খাবার যেমন কচুশাক ,চিনা বাদাম, তিল ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। তাছাড়া ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার যেমন টমেটো, গাজর, মিষ্টি আলু ইত্যাদি নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। মুড সুইং নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত সুষম খাদ্য গ্রহণ হতে পারে বেস্ট হাতিয়ার।

নিয়মিত ও পর্যাপ্ত ঘুম:

মানসিক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে চাইলে পর্যাপ্ত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। পর্যাপ্ত ঘুম হলে বিষন্নতা, বিভিন্ন মানসিক রোগ ও মুড সুইং এর সম্ভাবনা কমে আসে। আপনি যদি মুড সুইং, মানসিক ক্লান্তি, হতাশা থেকে দূরে থাকতে চান তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং নিয়মিত ঘুমানোর অভ্যাস করুন।

আরো পড়ুন:  পিরিয়ডের সময় মেয়েদের মুড সুইং কেন হয়?

যে কোনো আসক্তিকে না বলুন:

ধূমপান, মদ্যপান এবং মাদক গ্রহণ এবং আরো যত ধরণের নেগেটিভ আসক্তি আছে সবকিছু থেকে দূরে থাকুন। যে কোনো ধরণের নেগেটিভ আসক্তি আমাদের শরীর এবং মনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মুড সুইং নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে নেগেটিভ আসক্তিকে না বলতে হবে।

হাসিখুশি থাকা:

মানুষ যখন হাসিখুশি থাকে তখন অক্সিটোসিন’ নামক হরমোন নিঃসৃত হয়।  এই হরমোন মানসিক প্রশান্তি দেয়। ফলে মুড সুইংয়ের সম্ভাবনা কমে আসে। যে কাজগুলো করলে আপনার মন থাকে সেই কাজগুলো বেশি বেশি করার চেষ্টা করুন।

যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখা, ভালো মন্দ যাই ঘটুক মেনে নেওয়া, যতটা সম্ভব মানসিক চাপ থেকে নিজেকে দূরে রাখাসহ ইত্যাদি কাজগুলো আপনাকে মুড সুইং থেকে দূরে রাখবে।

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

এই আর্টিকেলটি লিখেছেন ফারজানা আক্তার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *